Featured

Type Here to Get Search Results !

২২৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী আম্মাজান জামে মসজিদ: এক বংশের দানশীলতা, ইতিহাস ও ইসলামী ধারা বহনকারী ইবাদতগাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক: কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁও মুড়াদরগা সড়কের পাশে দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে এলাকার ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী—আম্মাজান জামে মসজিদ। প্রায় সোয়া দুই শতাব্দীর প্রাচীন এ মসজিদটির উন্নয়ন, বিস্তার ও পরিচিতির পেছনে রয়েছে এক মহৎ পরিবারের ইবাদতপ্রেম, সমাজসেবা ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্যের দীর্ঘ গল্প।

ঐতিহ্যের শেকড়: ঈসমাইল আলী চৌধুরীর জীবন ও অবদান:- লাকসামের বিখ্যাত জমিদার হেকিম সিকান্দার আলী চৌধুরীর দ্বিতীয় সন্তান হেকিম ঈসমাইল আলী চৌধুরী (১৮৯৬–১৯৮০) ছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও পশ্চিমগাঁওয়ের বাগিচা বাড়ির উত্তরাধিকারী।

একাধারে চিকিৎসাবিদ, ক্যালিগ্রাফার, লেখক, ধর্মচিন্তাবিদ ও সমাজসেবক—বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ঈসমাইল আলী চৌধুরী আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজিয়েট থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং পরে দিল্লি থেকে হেকিমি বিদ্যায় উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন। বাংলা, উর্দু, ফারসি ও ইংরেজিতে সাবলীল হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ সেনা অফিসারদের ভাষা শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর মেধার এক অসাধারণ নিদর্শন বাংলার প্রথম শতবর্ষ পঞ্জিকা “বিস্ময়কর শতাব্দী পঞ্জিকা”, যা ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি এবং রানি ভিক্টোরিয়ার পক্ষ থেকে অভিনন্দন লাভ করে।

এছাড়াও তাঁর রচনা “প্রেমিক প্রদীপ” ও “গুলযারে যারাফাত” সাহিত্যাঙ্গনে স্থায়ী দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

৪০ বছরের মতো সময় তিনি বিনা পারিশ্রমিকে স্থানীয় মানুষের মাঝে কুরআনের আলো ছড়িয়ে দেন। সমাজে বিদআত প্রতিরোধে গঠন করেন “রদ্দে বেদাত” সংগঠন। লাকসাম পৌরসভা ও তিন ইউনিয়নে নিকাহ রেজিস্ট্রার (গেজেটেড কর্মকর্তা) হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।

আম্মাজানের গল্প: মানবিকতা থেকে জন্ম নেওয়া এক সম্মানসূচক নাম।

ঈসমাইল আলী চৌধুরীর স্ত্রী হুসনে আরা চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মগাদিয়া জমিদার বাড়ির কন্যা। তিনি সমাজকল্যাণ ও ধর্মীয় শিক্ষা বিতরণে অনন্য ভূমিকা রাখেন। নারীদের মাঝে কুরআন শিক্ষা, বিপদগ্রস্তদের সাহায্য ও কল্যাণমূলক কাজে তাঁর সক্রিয়তা তাঁকে এলাকার মানুষের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দেয়।

মানুষের প্রতি অপরিসীম মমতা ও অভিভাবকের মতো আচরণের জন্য স্থানীয়রা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ডাকতে থাকেন “আম্মাজান” নামে।

এরই সূত্র ধরে পশ্চিমগাঁও মিয়া পাড়া জামে মসজিদটি পরিচিতি পায় আম্মাজান জামে মসজিদ নামে, যা আজও সবার মুখে মুখে।

মসজিদের মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব: চার প্রজন্ম ধরে এক পরিবারের হাতে:- পশ্চিমগাঁওয়ের ‘গরীব মঞ্জিল’—ঈসমাইল আলী চৌধুরীর নিজস্ব বাসভবন—ওয়ারিশসূত্রে গ্রহণের সময় তিনি শর্ত রাখেন যে, মসজিদের মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব তাঁর বংশধররা পালন করবেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজও চৌধুরী পরিবার দায়িত্ব পালন করে আসছে নিষ্ঠার সঙ্গে।

সময়ের সাথে পুরোনো মসজিদটির মেঝে, দেয়াল ও ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং মুসল্লির সংখ্যা বাড়ায় জায়গা কমে আসতে থাকে।

২০১০ সাল থেকে কয়েক দফা সংস্কার শেষে পরিবারটি মসজিদের জমি ওয়াকফ করে চারতলা বিশিষ্ট আধুনিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।

২০২৫ সালের শুরুতে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। চলতি বছরের ২৪ অক্টোবর মসজিদের মুতাওয়াল্লি হায়াত চৌধুরী, গুলশান তাকওয়া সোসাইটি মসজিদের খতিব মুফতি সাইফুল ইসলামসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে 'আম্মাজান জামে মসজিদ এন্ড মক্তব একাডেমি কমপ্লেক্স' আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মনজুরে ইলাহী। 

মসজিদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অগ্রগতি প্রসঙ্গে বর্তমান সভাপতি মোঃ মিজানুর রশিদ বলেন, “আম্মাজান জামে মসজিদ আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। নতুন ভবন নির্মাণে আম্মাজান পরিবার এবং এলাকার মানুষের সহযোগিতা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। আমরা চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ মসজিদে আরও সুন্দর, প্রশস্ত ও আধুনিক পরিবেশে ইবাদত করতে পারে।”

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ মোখলেছুর রহমান জানান, “পুরাতন মসজিদটির স্থান সংকুলান এবং জরাজীর্ণ অবস্থা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে ও সবার সহযোগিতায় নতুন চারতলা ভবন নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে।”

ঈসমাইল আলী চৌধুরীর সন্তানগণ: উত্তরাধিকার ও অবদান-

১. সওকাত ছাদি: ১৯৩৭ সালে জন্ম। কানাডার কাস্টমস বিভাগে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘদিন আম্মাজান মসজিদের মুতাওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২. শাফকাত আরা চৌধুরী: প্রথম কন্যা। অল্প বয়সে ইন্তেকাল করেন।

৩. উলফত আরা চৌধুরী: ১৯৩৯ সালে জন্ম। খাদ্য সচিবালয়ের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম খানের স্ত্রী। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস।

৪. হায়াত চৌধুরী: ১৯৫৬ সালে জন্ম। কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস। বর্তমানে Toronto Islamic Center-এর সভাপতি ও আম্মাজান জামে মসজিদের বর্তমান মুতাওয়াল্লি। তিনি ২০০৮ সালে অর্জন করেন Ontario Volunteer Service Award।

৫. খাদেম রাসুল চৌধুরী: ১৯৬৪ সালে জন্ম। কানাডা সরকারের কর্মকর্তা। তিনি ১৯৯৩ সালে Governor General’s 125th Commemorative Medal লাভ করেন।

এক পরিবার, এক মসজিদ, দুই শতাব্দীর ঐতিহ্য: এলাকাবাসীর মতে- ধর্মীয় চেতনা, মানবসেবা, শিক্ষা বিস্তার ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের যে অসাধারণ ধারায় আম্মাজান পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাজ করে এসেছে, আম্মাজান জামে মসজিদ তারই জীবন্ত প্রতীক।

নতুন ভবন নির্মিত হলে মসজিদটি শুধু লাকসামের নয়; পুরো কুমিল্লা অঞ্চলের অন্যতম ঐতিহাসিক, আধুনিক ও সমৃদ্ধ ইসলামী কেন্দ্র হিসেবে আরও বৃহৎ পরিচিতি লাভ করবে—এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।

Top Post Ad

আলমাছ ষ্টীল এন্ড স্টান্ডার্ড ফার্ণিচার